Sunday, January 9, 2011

স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে অর্থের নিশ্চয়তা চান গবেষকরা : পাটের জন্মরহস্য উদ্ভাবন বদলে দিতে পারে অর্থনীতি

স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে অর্থের নিশ্চয়তা চান গবেষকরা:
পাটের জন্মরহস্য উদ্ভাবন বদলে দিতে পারে অর্থনীতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পাটের জেনম সিকোয়েন্স (জন্ম রহস্য) বদলে দিতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। জেনম সিকোয়েন্সের বীজ দিয়ে পাট চাষ হতে পারে উপকূলীয় লবণাক্ত মাটিতেও। গড়ে তোলা যেতে পারে ওষুধ শিল্প। এই প্রযুক্তির পাটে রোগবালাই হবে না। খরা, বন্যার মাঝেও ফলন ঠিক থাকে। এসব লক্ষ্য সামনে রেখে শুরু হয়েছে সোনালি আঁশ পাটের জেনম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের স্বপ্নযাত্রা। এই স্বপ্নকে বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে গবেষকরা সরকারের কাছে জরুরী ভিত্তিতে অবকাঠামো এবং অর্থ সরবরাহের নিশ্চয়তা চেয়েছেন।
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সমবেত হয়ে তাঁরা সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশে মেধার ঘাটতি নেই। এখন যে সমস্যা দেখা দিতে পারে, তা হচ্ছে অবকাঠামো এবং অর্থের। পাটের জেনম সিকোয়েন্স উদ্ঘাটনের সুফল দেশের কৃষক সমাজে পৌঁছে দেয়াই এখন বড় একটি চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে এই রহস্য উদ্ঘাটনে জড়িত গবেষকদের অনুপ্রেরণা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যদিও সরকারের উদ্যোগেই সম্ভব হয়েছে পাটের জেনম সিকোয়েন্স। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর উদ্যোগের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
তবে কাজ এখনও অনেক বাকি আছে। গবেষণা দলের প্রধান ডক্টর মাকসুদুল আলম বলেছেন, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির কারণে বোম মারলেও আমি এই মুহূর্তে বলব না যে গবেষণা কাজের অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে। তবে এটুকু বলতে চাই, আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এই গবেষণার পূর্ণাঙ্গ ফল এবং কৃষকদের হাতে জেনম সিকোয়েন্সের উদ্ভাবিত বীজ পৌঁছে দিতে সবের্াচ্চ ৫ বছর সময় লাগবে। কারণ এখনও খুঁটিনাটি অনেক কাজ বাকি আছে। দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেও এটা সম্ভব হতে পারে। তবে সময় নির্দিষ্ট করা যাবে না। এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে অর্থের নিশ্চয়তা। সরকার আমাকে বলেছে, করো এবং প্রয়োজনীয় বৈধ কাগজপত্রও আমাকে সরবরাহ করা হয়েছে। তবে অর্থের গ্যারান্টি এখনও পাওয়া যায়নি। আমাদের মেধার অভাব নেই। গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু অবকাঠামো সমস্যা আছে। এটা ঠিক করা প্রয়োজন। এর সঙ্গে অর্থের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে উপস্থিত হন ডক্টর মাকসুদুল আলমসহ গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত তরম্নণ গবেষকবৃন্দ। তারা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে এই গবেষণা চালান। এদের মধ্যে দশজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকুলার বায়োলজির ছাত্রছাত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক দলের সদস্য শারমিন শাম্য গবেষণার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশপ্রেমের কারণে পাটের জন্ম রহস্য উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। কখনও দেখা গেছে বিদু্যতের অসহ্য লোডশেডিং। তারপরও এই কাজটি করতে তারা গর্ববোধ করেছেন। তারা বিশ্বাস করেছেন একদিন তাদের এই গবেষণা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে। তারা এই গবেষণাকে চূড়ান্ত রূপ দিতেও অঙ্গিকারাবদ্ধ। তবে তার জন্য সরকার ও বেসরকারী খাতের উৎসাহ থাকা প্রয়োজন। তরম্নণ গবেষক পলাশ বলেন, গবেষকদের কেউ কেউ বিদেশে চলে যেতে চান। তারা যাতে বিদেশে না গিয়ে দেশে অবস্থান করেন সেদিকেও সরকারের নজর থাকা প্রয়োজন। অতীতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার কারণে এমন অনেক গবেষক বিদেশে চলে গেছেন। গত বছর ডিসেম্বর মাসে যখন পাটের জেনম সিকোয়েন্স নিয়ে কাজ শুরু হয় তখন সবার মনে এটি ছিল একটি স্বপ্ন। আর এই কারণে সেদিন এই প্রকল্পের নাম রাখা হয়েছিল স্বপ্নযাত্রা। এই মহৎ যাত্রাকে এগিয়ে নিতে তারা সংবাদ মাধ্যমেরও ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। তরম্নণ গবেষক সরোজ রায় বলেন, এই গবেষণার সময় নিয়ে আমরা চিনত্মিত হইনি। প্রতিদিন ষোলো থেকে আঠারো ঘণ্টা আমরা কাজ করেছি। এ সব করা হয়েছে দেশের জন্য।
জেনম সিকোয়েন্সের ব্যাখ্যা দিয়ে গবেষকরা বলেন, এই প্রযুক্তির ফলে উদ্ভিদের কিছু জিনকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়, যার ফলে পাল্টে যায় গুণাবলী। উন্নত গুণাবলীর বীজ উদ্ভাবন, দ্রম্নত উৎপাদন ক্ষমতা, উন্নত সংরক্ষণ ক্ষমতা এবং অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ করা সম্ভব হয়। এই প্রযুক্তিতে বীজ ও চারার আগাছা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যায়। খরা, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে উৎপাদন ধরে রাখতে সহায়তা করে এই প্রযুক্তি। জেনম সিকোয়েন্সের বীজ দিয়ে লবণাক্ত মাটিতেও পাট উৎপাদন করা যাবে। উপকুলীয় এলাকাতেও হবে পাটের চাষ। জেনম সিকোয়েন্সের ফলে পাটকে কেন্দ্র করে ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার সম্ভাবনাও রয়েছে।
গবেষণা টিমের আরেক সদস্য সামিউল হক বলেন, উন্নতমানের পাটের আঁশ নির্ভর করে পানিতে পচানোর ওপর। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয় ও অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে দেশে পাট পচানোর মতো পর্যাপ্ত জলাশয় কমে আসছে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে কম পানিতে বিশেষ পদ্ধতিতে যাতে পাট পচানো যায় সে ব্যাপারে গবেষণা করা হচ্ছে। গবেষক শহিদুল ইসলাম বলেন, পাটের জেনম সিকোয়েন্সির ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির মালিক থাকবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এককভাবেই এই প্রযুক্তির কৃতিত্ব অর্জন করতে যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। ভবিষ্যতে কোন দেশ কিংবা বিদেশী কোন প্রতিষ্ঠান পাট নিয়ে গবেষণা করতে হলে বাংলাদেশের অনুমতি নিতে হবে। হাওয়াই-এর জাতীয় আয়ের বড় উৎস হচ্ছে পেঁপে। সেদেশে পেঁপের জেনম সিকোয়েন্স করার পর তাদের উন্নত জাতের পেঁপে উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। একইভাবে মালশেয়িায় করা হয়েছে রবারের জেনম সিকোয়েন্স। আর এই দু'টি জেনম সিকোয়েন্স উদ্ভাবনের কৃতিত্বও পাটের জেনম সিকোয়েন্স করার গবেষক দলের প্রধান ডক্টর মাকসুদুল আলম। সেদিক থেকেও তিনি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন।
ডক্টর মাকসুদুল আলম এই গবেষণাকে চূড়ানত্ম রূপ দিতে সরকারের সাহায্য নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে আরও বলেন, আমি বামপন্থী নই, আবার ডানপন্থীও নই। আমি জানি সরকারও এই গবেষণার ব্যাপারে উদার। তাই আশা করি, সাহায্যের কোন সমস্যা হবে না। তবে সাহায্যগুলো আসতে হবে পূর্ণাঙ্গভাবে। আমার আছে দেশপ্রেম। দেশের স্বার্থেই আমি এই কাজটি চালিয়ে যেতে চাই। অনেক প্রতিযোগিতার মধ্যেও মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে আমরা পাটের জেনম সিকোয়েন্স করতে সক্ষম হয়েছি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা না দেয়া পর্যনত্ম কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল।
Source:Daily janakantha

No comments:

Post a Comment