মূল রচনা
সোনালি আঁশের সোনালি মানুষ
বুড়িগঙ্গার তীরে কামরাঙ্গীরচরের ছোট্ট শখের গবেষণাগার থেকে যাত্রা শুরু। ছোটবেলার সেই উদ্ভাবনের নেশাই গবেষক হিসেবে মাকসুদুল আলমকে নিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। পেঁপে ও রাবারের পর সম্প্রতি পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এই অধ্যাপক। তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী জার্নাল ন্যাচার। বিশ্বখ্যাত এই বাংলাদেশি উদ্ভাবককে নিয়ে এবারের মূল রচনা লিখেছেন ইফতেখার মাহমুদ
‘আমি তখন ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ি। বাবা বুড়িগঙ্গার পারে কামরাঙ্গীরচরে এক খণ্ড জমি কিনলেন। সেখানে একটি ঘরও তৈরি করলেন। আমি প্রায়ই সেখানে যেতাম। নিজের উদ্যোগেই ঘরের এক কোণে একটি গবেষণাগার তৈরি করলাম। বিভিন্ন উদ্ভিদের লতাপাতা এনে একটার সঙ্গে আরেকটা মিলিয়ে দেখতাম, কী হয়। প্রাণরসায়ন নিয়ে গবেষণায় হাতেখড়ি আমার সেখান থেকেই।’ সোনালি আঁশ পাটের জিন-নকশা উন্মোচনকারী দলের নেতা প্রবাসী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম বলছিলেন প্রাণরসায়ন নিয়ে তাঁর গবেষণার শুরুর গল্প। হ্যাঁ, শুরুটা এ রকম সাদামাটাভাবেই।
কামরাঙ্গীরচরের ওই টিনের তৈরি ছোট্ট শখের গবেষণাগার থেকে মাকসুদুল আলম পৌঁছে গেছেন রাশিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র হয়ে মালয়েশিয়ার বড় বড় গবেষণাকেন্দ্রে। পেঁপে, রাবার ও সর্বশেষ পাটের মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের জীবনরহস্য উন্মোচন করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এই গবেষক। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী জার্নাল ন্যাচার মাকসুদুল আলমকে নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাঁকে ‘বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
১৬ জুন মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের সংবাদ শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করেছে। পাট নিয়ে একই ধরনের গবেষণা করছে এমন প্রতিযোগী দেশগুলোর গণমাধ্যমে সংবাদটিকে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে দেশের বিজ্ঞানীদের সমালোচনা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মাকসুদুল আলম ও তাঁর দলের এ সাফল্য দিয়েছে বাংলাদেশের সোনালি আঁশের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার সুখবর।
ঢ্যাঁড়স দিয়ে শুরু
জিন নকশা উন্মোচনে মাকসুদুল আলমের আগ্রহের শুরুটা হয়েছিল ঢ্যাঁড়স থেকে। গল্পটা শোনা যাক তাঁর কাছ থেকেই, ‘একবার দেশে প্রচণ্ড বন্যা হলো। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বাবা আমাদের জমিতে ঢ্যাঁড়সের বীজ লাগালেন। কয়েক মাস পর দেখলাম, সেখানে বিশাল আকৃতির ঢ্যাঁড়স হয়েছে। এত বড় ঢ্যাঁড়স আগে কখনো দেখিনি। অবাক হয়ে ভাবলাম, বন্যার আগেও তো বাবা ঢ্যাঁড়সের চারা রোপণ করেছিলেন। কিন্তু এবার এত বড় আকৃতির ঢ্যাঁড়স কীভাবে হলো? এই গভীর রহস্যময় আচরণ আমাকে ভাবিয়ে তুলল। ভাবলাম, নিশ্চয়ই এখানে মাটি, পানি ও বীজের মধ্যে এমন কোনো সমন্বয়ের ব্যাপার আছে, যা ফসলের চেহারা ও আকৃতি একেক সময় একেক রকম করে। কী করলে সারা বছর ও সব জায়গায় একই রকমের উন্নত ফসল পাওয়া সম্ভব, তা অনুসন্ধান করতে থাকলাম। এভাবেই রহস্য উন্মোচনের পথে আমার যাত্রা শুরু।’
পিলখানা থেকে হাওয়াই
মাকসুদুল আলমের জন্ম ফরিদপুরে। সালটা ১৯৫৪। বাবার বিডিআরে চাকরির সূত্রে ঢাকা পিলখানাতেই কেটেছে শৈশব-কৈশোর। ছোট ভাইয়ের শৈশবের কথা বলতে গিয়ে মেজর জেনারেল (অব.) মনজুরুল আলম (বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম্যান) বলছিলেন, ‘পিলখানার খেলার মাঠে বিকেলবেলা সব ছেলেপেলের দল হইহুল্লোড় করে খেলাধুলা করত। মাকসুদুল সবার সঙ্গে যোগ দিলেও মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যেত কোথায় যেন। অনেক খুঁজে তাকে শেষে পাওয়া যেত কোনো গাছগাছালি অথবা লতাপাতার সামনে। লতাগুল্ম নেড়ে নিবিষ্ট মনে কী যেন দেখছে মাকসুদুল। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটত।’ এভাবেই কাটছিল ছোটবেলা। এর মধ্যেই এল একাত্তর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম সপ্তাহেই পাকিস্তানি বাহিনী মাকসুদুলের বাবা দলিলউদ্দিন আহমেদকে ধরে নিয়ে যায়। সে বছরের ৩ এপ্রিল পিলখানার এক কোনায় বিডিআরের বেশ কয়েকজন সদস্যকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। সেখানে দলিলউদ্দিনও ছিলেন।
ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে মাকসুদুল উচ্চশিক্ষা নিতে চলে যান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে অণুজীববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি শেষ করেন। মাকসুদুল তাঁর দ্বিতীয় পিএইচডি করেন জার্মানির ম্যাক্স প্লানক ইনস্টিটিউট থেকে। এরপর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৯৭ সালে পান এনআইএইচ শ্যানান অ্যাওয়ার্ড। অণুজীববিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। ২০০১ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোর্ড অব রিজেন্টস এক্সেলেন্স অব রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।
মায়ের সংগ্রাম
বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরলেন মা লিরিয়ান আহমেদ। মাত্র নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন তিনি। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। এই নারী তাঁর আট সন্তানকে একদিন ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।’ মায়ের সেদিনকার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন সন্তানেরা।
কাপড় সেলাই করাকে পেশা হিসেবে নিয়ে মা লিরিয়ান আহমেদ সংসারের খরচ চালাতেন। মাকসুদুল ও তাঁর বড় ভাই মনজুরুলসহ চার ভাই ও চার বোনের সবাই টিউশনি করে নিজেদের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেন। মায়ের নিরলস সংগ্রাম আর সাধনার গুণেই সংসারে সুদিন এল একদিন। সবার বড় বোন শামসুন নাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে যোগ দিলেন। অন্য ভাই-বোনদের উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব নিলেন। পাটের জিন-নকশা উন্মোচনকারী এই বিজ্ঞানী নিজের জীবনের সাফল্যের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে বললেন, ‘নিজের গায়ের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে দিলেও আমার বড় বোনের ঋণ শোধ হবে না। তিনি আমার জন্য যা করেছেন, তা না পেলে আমার পক্ষে এত দূর আসা সম্ভব হতো না।’ বলতে না বলতেই তাঁর চোখ জলে ছলছল। মায়ের কথা বলতে গিয়ে আবেগ আর চোখের জলে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল আবারও। ‘সব ভাই-বোনকে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত করে বিয়ে দিয়ে মা মারা গেলেন ১৯৯৮ সালে। ঠিক বাবার মৃত্যুর দিন, ৩ জুন।’ বলে একটু থামলেন মাকসুদুল। তারপর বললেন, ‘একজন সচেতন মা পারেন একটি শিক্ষিত জাতি তৈরি করতে। আমার মা পড়াশোনা কম জানলেও তিনি শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। বাংলাদেশকে বিজ্ঞানে এগিয়ে নিতে হলে নারীদের বিজ্ঞানমুখী করতে হবে। তারাই মা হয়ে তার সব সন্তানকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে পারবে। ফলে এর প্রভাব হবে বহুমুখী। এই যেমন, মালয়েশিয়ার ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বেশি এগিয়ে।’
সোনালি আঁশের সোনালি আশা
‘যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পেঁপের জীবনরহস্য উন্মোচনের (জেনোম সিকোয়েন্সিং) সময় আমার শুধু আফসোস হয়েছে দেশের জন্য কিছু করতে পারলাম না বলে। সুযোগ পেলে আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজনীয় শস্য ও ফসলের জিন-নকশা উন্মোচন করার সাধ তখন থেকেই ছিল।’ পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের আগ্রহের শুরুর গল্প বলছিলেন মাকসুদুল।
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই রাজ্যের প্রধান ফসল পেঁপে। জিন-নকশা উন্মোচনের পর তাঁরা বেশ কিছু নতুন জাত উদ্ভাবন করলেন। পেঁপের বেশ কিছু রোগ হতো। পোকার আক্রমণে প্রচুর পেঁপে নষ্ট হতো। কৃষক বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হতো। উন্নত জাত উদ্ভাবন করে কৃষকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার পর তাদের ভাগ্য বদলে গেল। পেঁপের উৎপাদন বহুগুণে বেড়ে গেল। হাওয়াই রাজ্যের কৃষি-অর্থনীতির চেহারাই পাল্টে গেল। মনে হচ্ছিল, নিজের দেশের ধান, পাট, বনজ ঔষধি গাছগুলোর জিন-নকশা উন্মোচন করা গেলে দেশের কৃষির চেহারা পাল্টে দেওয়া সম্ভব হতো।
২০০৮ সালের শেষের দিকে মালয়েশিয়া সরকার জিন-নকশা নিয়ে গবেষণা করার জন্য একটি বড় গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করে। সেখানে মাকসুদুলের ডাক পড়ল রাবারের নিয়ে গবেষণা করার জন্য। তাঁর সঙ্গে হাওয়াই থেকেও কয়েকজন যোগ দিলেন। ২০০৯ সালের নভেম্বরের মধ্যেই তাঁরা রাবারের জেনোম সিকোয়েন্সিং উন্মোচন করে ফেললেন। তখন আরও বেশি করে দেশের জন্য কাজ করার আগ্রহ বোধ করলেন। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। প্রাণরসায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন এমন বন্ধুরা শুনেই উৎসাহ দেখালেন। তাঁরা বললেন, যেকোনো মূল্যে এটা হতেই হবে, তাঁরাই পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করবেন।
২০০৮ সালের জুন মাসে তৈরি হলো স্বপ্নযাত্রা নামের একটি উদ্যোগ। প্রবীণ-নবীন মিলিয়ে ৭২ জন বিজ্ঞানী ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ যোগ দিলেন সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান ও জেবা সিরাজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী যোগ দিলেন। নিজেদের অর্থ ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে তাঁরা কাজ শুরু করলেন। পাটের জিনের প্রায় দুই কোটি তথ্য হাতে চলে এল। কিন্তু বাধা এল এর পরপরই। সে বাধা কাটিয়েও ওঠা গেল।
‘গবেষণার একটি পর্যায়ে গিয়ে টাকার কারণে আটকে গেলাম। প্রথম আলোতে আমাদের গবেষণা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ফোন করলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করলাম। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে অর্থসহায়তা দেওয়ার ঘটনা আমাদের হতাশা কাটিয়ে সাফল্যের দিকে নিয়ে গেল।’ বলছিলেন মাকসুদুল আলম।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে অর্থসহায়তা দেওয়ার পর ৩ জানুয়ারি আরও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হলো। গবেষণা শুরুর আগে সবাই লিখিতভাবে চুক্তিবদ্ধ হলেন পুরো গবেষণা শেষ হওয়ার আগে কেউ কোনো তথ্য বাইরে কারও কাছে বলবেন না। গবেষকদলের ৪২ জন সদস্যের সবাই তা মেনে চলেছেন। মাকসুদুল আলমসহ গবেষকদের কেউই এ গবেষণার জন্য পারিশ্রমিক নেননি। গবেষকদের সবার পরিচয়ই গোপন রাখা হয়েছে।
তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ—১৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানালেন সুখবর—পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে ছাপা হলো এই উদ্ভাবনের খবর।
পাটের জিনোম বদলে দেবে বাংলাদেশকে
পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের প্রধান কৃতিত্ব তরুণ গবেষকদের দিতে চান মাকসুদুল আলম।
গবেষণাটি সফলভাবে শেষ করতে নিজেদের ব্যক্তিগত অনেক বিষয়ে তাঁদের ছাড় দিতে হয়েছে।
গবেষণা চলাকালে একজন সহযোগী গবেষকের মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মাকে হাসপাতালে রেখে তিনি প্রতিদিন তাঁর গবেষণার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মা মারা যাওয়ার তিন দিনের মাথায় আবারও কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
সবাইকে দিনরাত পরিশ্রম করে কাজ করতে হয়েছে।
পাটের পর তুলসীসহ নানা দেশি ঔষধি গাছের জিন-নকশা উন্মোচন করতে চান মাকসুদুল আলম। দেশের প্রাণরসায়নবিজ্ঞানীদের উন্নীত করতে চান বিশ্বমানে।
এ জন্য তরুণ গবেষকদের দেশে ধরে রাখাটাকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।
আর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, যদি তরুণদের জন্য গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, তবে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না বাংলাদেশকে।
Source: Daily Prothom-Alo‘আমি তখন ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ি। বাবা বুড়িগঙ্গার পারে কামরাঙ্গীরচরে এক খণ্ড জমি কিনলেন। সেখানে একটি ঘরও তৈরি করলেন। আমি প্রায়ই সেখানে যেতাম। নিজের উদ্যোগেই ঘরের এক কোণে একটি গবেষণাগার তৈরি করলাম। বিভিন্ন উদ্ভিদের লতাপাতা এনে একটার সঙ্গে আরেকটা মিলিয়ে দেখতাম, কী হয়। প্রাণরসায়ন নিয়ে গবেষণায় হাতেখড়ি আমার সেখান থেকেই।’ সোনালি আঁশ পাটের জিন-নকশা উন্মোচনকারী দলের নেতা প্রবাসী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম বলছিলেন প্রাণরসায়ন নিয়ে তাঁর গবেষণার শুরুর গল্প। হ্যাঁ, শুরুটা এ রকম সাদামাটাভাবেই।
কামরাঙ্গীরচরের ওই টিনের তৈরি ছোট্ট শখের গবেষণাগার থেকে মাকসুদুল আলম পৌঁছে গেছেন রাশিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র হয়ে মালয়েশিয়ার বড় বড় গবেষণাকেন্দ্রে। পেঁপে, রাবার ও সর্বশেষ পাটের মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের জীবনরহস্য উন্মোচন করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এই গবেষক। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী জার্নাল ন্যাচার মাকসুদুল আলমকে নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাঁকে ‘বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
১৬ জুন মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের সংবাদ শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করেছে। পাট নিয়ে একই ধরনের গবেষণা করছে এমন প্রতিযোগী দেশগুলোর গণমাধ্যমে সংবাদটিকে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে দেশের বিজ্ঞানীদের সমালোচনা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মাকসুদুল আলম ও তাঁর দলের এ সাফল্য দিয়েছে বাংলাদেশের সোনালি আঁশের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার সুখবর।
ঢ্যাঁড়স দিয়ে শুরু
জিন নকশা উন্মোচনে মাকসুদুল আলমের আগ্রহের শুরুটা হয়েছিল ঢ্যাঁড়স থেকে। গল্পটা শোনা যাক তাঁর কাছ থেকেই, ‘একবার দেশে প্রচণ্ড বন্যা হলো। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বাবা আমাদের জমিতে ঢ্যাঁড়সের বীজ লাগালেন। কয়েক মাস পর দেখলাম, সেখানে বিশাল আকৃতির ঢ্যাঁড়স হয়েছে। এত বড় ঢ্যাঁড়স আগে কখনো দেখিনি। অবাক হয়ে ভাবলাম, বন্যার আগেও তো বাবা ঢ্যাঁড়সের চারা রোপণ করেছিলেন। কিন্তু এবার এত বড় আকৃতির ঢ্যাঁড়স কীভাবে হলো? এই গভীর রহস্যময় আচরণ আমাকে ভাবিয়ে তুলল। ভাবলাম, নিশ্চয়ই এখানে মাটি, পানি ও বীজের মধ্যে এমন কোনো সমন্বয়ের ব্যাপার আছে, যা ফসলের চেহারা ও আকৃতি একেক সময় একেক রকম করে। কী করলে সারা বছর ও সব জায়গায় একই রকমের উন্নত ফসল পাওয়া সম্ভব, তা অনুসন্ধান করতে থাকলাম। এভাবেই রহস্য উন্মোচনের পথে আমার যাত্রা শুরু।’
পিলখানা থেকে হাওয়াই
মাকসুদুল আলমের জন্ম ফরিদপুরে। সালটা ১৯৫৪। বাবার বিডিআরে চাকরির সূত্রে ঢাকা পিলখানাতেই কেটেছে শৈশব-কৈশোর। ছোট ভাইয়ের শৈশবের কথা বলতে গিয়ে মেজর জেনারেল (অব.) মনজুরুল আলম (বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম্যান) বলছিলেন, ‘পিলখানার খেলার মাঠে বিকেলবেলা সব ছেলেপেলের দল হইহুল্লোড় করে খেলাধুলা করত। মাকসুদুল সবার সঙ্গে যোগ দিলেও মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যেত কোথায় যেন। অনেক খুঁজে তাকে শেষে পাওয়া যেত কোনো গাছগাছালি অথবা লতাপাতার সামনে। লতাগুল্ম নেড়ে নিবিষ্ট মনে কী যেন দেখছে মাকসুদুল। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটত।’ এভাবেই কাটছিল ছোটবেলা। এর মধ্যেই এল একাত্তর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম সপ্তাহেই পাকিস্তানি বাহিনী মাকসুদুলের বাবা দলিলউদ্দিন আহমেদকে ধরে নিয়ে যায়। সে বছরের ৩ এপ্রিল পিলখানার এক কোনায় বিডিআরের বেশ কয়েকজন সদস্যকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। সেখানে দলিলউদ্দিনও ছিলেন।
ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে মাকসুদুল উচ্চশিক্ষা নিতে চলে যান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে অণুজীববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি শেষ করেন। মাকসুদুল তাঁর দ্বিতীয় পিএইচডি করেন জার্মানির ম্যাক্স প্লানক ইনস্টিটিউট থেকে। এরপর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৯৭ সালে পান এনআইএইচ শ্যানান অ্যাওয়ার্ড। অণুজীববিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। ২০০১ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোর্ড অব রিজেন্টস এক্সেলেন্স অব রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।
মায়ের সংগ্রাম
বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরলেন মা লিরিয়ান আহমেদ। মাত্র নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন তিনি। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। এই নারী তাঁর আট সন্তানকে একদিন ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।’ মায়ের সেদিনকার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন সন্তানেরা।
কাপড় সেলাই করাকে পেশা হিসেবে নিয়ে মা লিরিয়ান আহমেদ সংসারের খরচ চালাতেন। মাকসুদুল ও তাঁর বড় ভাই মনজুরুলসহ চার ভাই ও চার বোনের সবাই টিউশনি করে নিজেদের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেন। মায়ের নিরলস সংগ্রাম আর সাধনার গুণেই সংসারে সুদিন এল একদিন। সবার বড় বোন শামসুন নাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে যোগ দিলেন। অন্য ভাই-বোনদের উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব নিলেন। পাটের জিন-নকশা উন্মোচনকারী এই বিজ্ঞানী নিজের জীবনের সাফল্যের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে বললেন, ‘নিজের গায়ের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে দিলেও আমার বড় বোনের ঋণ শোধ হবে না। তিনি আমার জন্য যা করেছেন, তা না পেলে আমার পক্ষে এত দূর আসা সম্ভব হতো না।’ বলতে না বলতেই তাঁর চোখ জলে ছলছল। মায়ের কথা বলতে গিয়ে আবেগ আর চোখের জলে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল আবারও। ‘সব ভাই-বোনকে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত করে বিয়ে দিয়ে মা মারা গেলেন ১৯৯৮ সালে। ঠিক বাবার মৃত্যুর দিন, ৩ জুন।’ বলে একটু থামলেন মাকসুদুল। তারপর বললেন, ‘একজন সচেতন মা পারেন একটি শিক্ষিত জাতি তৈরি করতে। আমার মা পড়াশোনা কম জানলেও তিনি শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। বাংলাদেশকে বিজ্ঞানে এগিয়ে নিতে হলে নারীদের বিজ্ঞানমুখী করতে হবে। তারাই মা হয়ে তার সব সন্তানকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে পারবে। ফলে এর প্রভাব হবে বহুমুখী। এই যেমন, মালয়েশিয়ার ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বেশি এগিয়ে।’
সোনালি আঁশের সোনালি আশা
‘যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পেঁপের জীবনরহস্য উন্মোচনের (জেনোম সিকোয়েন্সিং) সময় আমার শুধু আফসোস হয়েছে দেশের জন্য কিছু করতে পারলাম না বলে। সুযোগ পেলে আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজনীয় শস্য ও ফসলের জিন-নকশা উন্মোচন করার সাধ তখন থেকেই ছিল।’ পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের আগ্রহের শুরুর গল্প বলছিলেন মাকসুদুল।
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই রাজ্যের প্রধান ফসল পেঁপে। জিন-নকশা উন্মোচনের পর তাঁরা বেশ কিছু নতুন জাত উদ্ভাবন করলেন। পেঁপের বেশ কিছু রোগ হতো। পোকার আক্রমণে প্রচুর পেঁপে নষ্ট হতো। কৃষক বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হতো। উন্নত জাত উদ্ভাবন করে কৃষকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার পর তাদের ভাগ্য বদলে গেল। পেঁপের উৎপাদন বহুগুণে বেড়ে গেল। হাওয়াই রাজ্যের কৃষি-অর্থনীতির চেহারাই পাল্টে গেল। মনে হচ্ছিল, নিজের দেশের ধান, পাট, বনজ ঔষধি গাছগুলোর জিন-নকশা উন্মোচন করা গেলে দেশের কৃষির চেহারা পাল্টে দেওয়া সম্ভব হতো।
২০০৮ সালের শেষের দিকে মালয়েশিয়া সরকার জিন-নকশা নিয়ে গবেষণা করার জন্য একটি বড় গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করে। সেখানে মাকসুদুলের ডাক পড়ল রাবারের নিয়ে গবেষণা করার জন্য। তাঁর সঙ্গে হাওয়াই থেকেও কয়েকজন যোগ দিলেন। ২০০৯ সালের নভেম্বরের মধ্যেই তাঁরা রাবারের জেনোম সিকোয়েন্সিং উন্মোচন করে ফেললেন। তখন আরও বেশি করে দেশের জন্য কাজ করার আগ্রহ বোধ করলেন। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। প্রাণরসায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন এমন বন্ধুরা শুনেই উৎসাহ দেখালেন। তাঁরা বললেন, যেকোনো মূল্যে এটা হতেই হবে, তাঁরাই পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করবেন।
২০০৮ সালের জুন মাসে তৈরি হলো স্বপ্নযাত্রা নামের একটি উদ্যোগ। প্রবীণ-নবীন মিলিয়ে ৭২ জন বিজ্ঞানী ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ যোগ দিলেন সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান ও জেবা সিরাজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী যোগ দিলেন। নিজেদের অর্থ ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে তাঁরা কাজ শুরু করলেন। পাটের জিনের প্রায় দুই কোটি তথ্য হাতে চলে এল। কিন্তু বাধা এল এর পরপরই। সে বাধা কাটিয়েও ওঠা গেল।
‘গবেষণার একটি পর্যায়ে গিয়ে টাকার কারণে আটকে গেলাম। প্রথম আলোতে আমাদের গবেষণা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ফোন করলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করলাম। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে অর্থসহায়তা দেওয়ার ঘটনা আমাদের হতাশা কাটিয়ে সাফল্যের দিকে নিয়ে গেল।’ বলছিলেন মাকসুদুল আলম।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে অর্থসহায়তা দেওয়ার পর ৩ জানুয়ারি আরও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হলো। গবেষণা শুরুর আগে সবাই লিখিতভাবে চুক্তিবদ্ধ হলেন পুরো গবেষণা শেষ হওয়ার আগে কেউ কোনো তথ্য বাইরে কারও কাছে বলবেন না। গবেষকদলের ৪২ জন সদস্যের সবাই তা মেনে চলেছেন। মাকসুদুল আলমসহ গবেষকদের কেউই এ গবেষণার জন্য পারিশ্রমিক নেননি। গবেষকদের সবার পরিচয়ই গোপন রাখা হয়েছে।
তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ—১৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানালেন সুখবর—পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে ছাপা হলো এই উদ্ভাবনের খবর।
পাটের জিনোম বদলে দেবে বাংলাদেশকে
পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের প্রধান কৃতিত্ব তরুণ গবেষকদের দিতে চান মাকসুদুল আলম।
গবেষণাটি সফলভাবে শেষ করতে নিজেদের ব্যক্তিগত অনেক বিষয়ে তাঁদের ছাড় দিতে হয়েছে।
গবেষণা চলাকালে একজন সহযোগী গবেষকের মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মাকে হাসপাতালে রেখে তিনি প্রতিদিন তাঁর গবেষণার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মা মারা যাওয়ার তিন দিনের মাথায় আবারও কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
সবাইকে দিনরাত পরিশ্রম করে কাজ করতে হয়েছে।
পাটের পর তুলসীসহ নানা দেশি ঔষধি গাছের জিন-নকশা উন্মোচন করতে চান মাকসুদুল আলম। দেশের প্রাণরসায়নবিজ্ঞানীদের উন্নীত করতে চান বিশ্বমানে।
এ জন্য তরুণ গবেষকদের দেশে ধরে রাখাটাকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।
আর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, যদি তরুণদের জন্য গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, তবে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না বাংলাদেশকে।
No comments:
Post a Comment