Monday, January 17, 2011

পাঁচ বছরে রফতানি বেড়েছে ১শ' শতাংশ: ফিরে আসছে পাটের সোনালি দিন

পাঁচ বছরে রফতানি বেড়েছে ১শ' শতাংশ
ফিরে আসছে পাটের সোনালি দিন


কিসমত খোন্দকার
বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটের গৌরব অতীত আবার ফিরে আসছে। পাটের বহুমুখী ব্যবহার ও বিদেশে চাহিদা বাড়ার কারণে দেশের রফতানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় আবারও সন্মানজনক স্থান করে নিচ্ছে পাটখাত। কৃষক ন্যায্য দাম পাওয়ায় উৎসাহিত হচ্ছেন পাট চাষে। উৎপাদন বাড়ায় এ খাতে গত পাঁচ বছরে ১শ' শতাংশের বেশি আয় বেড়েছে। সর্বশেষ পাটের জিন নকশা উদ্ভাবন পাট নিয়ে আরও মর্যাদাশীল করে তুলেছে।
জানা গেছে, ২০০৫-০৬ অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে মোট ২৯৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকার পাট রফতানি হয়েছে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩০৭ কোটি ৬ লাখ, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৩৫৪ কোটি ২৪ লাখ, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৪৩১ কোটি ১১ লাখ এবং ২০০৯-১০ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৬৫২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত পাঁচ অর্থবছরে পাটের রফতানি আয় ১১৮ শতাংশ।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলো আবার চালু করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। অঙ্গীকার পূরণে সরকারি মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি পাটকল চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বন্ধ পাঁচটি পাটকল চালু করতে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সরকারের কাছে মোট ১৭২ কোটি টাকা চেয়েছিল। এর মধ্যে দুটি সরকারি পাটকল চালুর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি প্রায় ১০৫ কোটি টাকা ছাড় করেছে। পাটকল দুটির মেশিনারি কেনার জন্য এ অর্থ ব্যয় হবে। পাট ও বস্ত্র সচিব আশরাফুল মকবুল সমকালকে জানান, দিন দিন পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসছে। পাটচাষিরা দু'তিন বছর ধরে পাটের ন্যায্য দাম পাওয়ায় তারাও পাটচাষে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। বিশ্বজুড়ে পাটের চাহিদা বাড়ছে। পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি খাতে আয় বাড়ছে। এ অবস্থায় সরকারি মালিকানাধীন পাটকলগুলো চালুর সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। পাট সচিব আশরাফুল মকবুল বলেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট ৬ লাখ ৪২ হাজার বেল পাট ক্রয় করা হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ লাখ বেল। আমরা ক্রয় করেছি ৯ লাখ ২৯ হাজার বেল। পাট উৎপাদনকারী কৃষকরাও এ সময় ভালো দাম পেয়েছেন। ২০০৯ সালে প্রতি মণ পাটের দাম ছিল ২ হাজার ৭১৯ টাকা। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭৯৬ টাকা। কৃষক পাটের ভালো দাম পাওয়ায় তারা এখন পাটচাষে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। তিনি বলেন, পাট রফতানির পাশাপাশি এ সময় দেশে কর্মসংস্থানও বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট ৫৯ হাজার ৪৫৪ জন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৭৯২ জনে। অর্থাৎ মোট ২১ শতাংশ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃত্রিম তন্তু বা সিনথেটিক পণ্য নিষিদ্ধ হচ্ছে আর প্রাকৃতিক আঁশের তৈরি পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। আমরা এ সম্ভাবনাকে সামনে রেখে পাটকলগুলোকে আবার সচল করার উদ্যোগ নিয়েছি। আদমজী পাটকল আবার চালু করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের আছে কি-না এ প্রশ্নের জবাবে পাট সচিব জানান, আমরা কত বড় ভুল করেছি সেটা বুঝতে আরও কিছুদিন লাগবে। তবে আদমজী পাটকলকে আগের পর্যায়ে চালু করা সম্ভব হবে না হয়তো, তবে বিষয়টি সরকার ভাবছে। পাটের বহুমুখী ব্যবহারের বিষয়েও সরকার ভাবছে। পাট থেকে কাগজের মণ্ড বানানোর বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। পাকশী পেপার মিলে কাগজের মণ্ড তৈরির ইউনিটটি কাজে লাগানো হবে। পাট থেকে কাগজের মণ্ড তৈরি হলে বিদেশ থেকে কাগজ আমদানির নির্ভরতা কমবে। পাশাপাশি পাটের ব্যবহার বাড়বে। পাটের চাহিদা বাড়ানো গেলে কৃষকরাও পাটচাষে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। পাট সচিব বলেন, খুব শিগগিরই উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল মিয়ানমার ও চীন সফরে যাবে। সেখানকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশেই পাট থেকে মণ্ড উৎপাদনের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, পাটের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে এরই মধ্যে পাটের প্যাকেজিং সামগ্রী আইন-২০১০ অনুমোদন করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, পণ্য সরবরাহ ও পরিবহন করা যাবে না। বিশেষ করে খাদ্যশস্য, চিনি, সার, সিমেন্ট প্যাকিংয়ে পাট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে দেশে উৎপাদিত পাটের ৫০ শতাংশ প্যাকেজিংয়ের কাজে ব্যবহার হবে। এছাড় মণ্ড উপাদনেও বিপুল পরিমাণ পাট ব্যবহার হবে। সোনালি আঁশ পাট নিয়ে চলছে নানা ধরনের গবেষণা। 'স্টাইল অ্যান্ড ডিজাইন মেকস দ্য সেল' এ স্লোগান ধারণ করে বিভিন্ন সংস্থা পাট পণ্যের বহুমুখীকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পাট দিয়ে বস্তা, চট, কারপেট, ব্যাগসহ সনতানী নানা পণ্য প্রস্তুতের পাশাপাশি এখন তৈরি হচ্ছে ফাইবার, ইয়ার্ন ও ফেব্রিক্স জাতীয় শতাধিক পণ্য। এর মধ্যে রয়েছে কাগজ, কাগজের তৈরি বিভিন্ন পণ্য, জুট কম্পোজিটস, নন-ওভেন প্রডাক্টস উইপস, মেডিকেয়ার টেক্সটাইলস, বন্ডিং মেটেরিয়ালস, সেলুলোজ, সিটস, প্যানেলস, ফ্লোর টাইলস, ফাইনার ইয়ার্ন, ডায়েড ইয়ার্ন, কোটেট ইয়ার্ন, ফেন্সি ইয়ার্ন, মাল্টি প্লায়েড ইয়ার্ন, জুতা, স্যান্ডেল, গিফট বক্স, সেমিনার ব্যাগ, ফোল্ডারসহ বিভিন্ন পণ্য। এছাড়াও জাপান, আমেরিকা ও জার্মানে উৎপাদিত গাড়িতে পাট থেকে তৈরি পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন পণ্য পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু করেছে। অর্থাৎ পাট আবার তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাচ্ছে।
Source: Daily Samakal, January-2011

Friday, January 14, 2011

সোনালি আঁশের সোনালি মানুষ

মূল রচনা

সোনালি আঁশের সোনালি মানুষ

মাকসুদুল আলম | তারিখ: ১৯-০৬-২০১০

গবেষক মাকসুদুল আলম
বুড়িগঙ্গার তীরে কামরাঙ্গীরচরের ছোট্ট শখের গবেষণাগার থেকে যাত্রা শুরু। ছোটবেলার সেই উদ্ভাবনের নেশাই গবেষক হিসেবে মাকসুদুল আলমকে নিয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। পেঁপে ও রাবারের পর সম্প্রতি পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এই অধ্যাপক। তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী জার্নাল ন্যাচার। বিশ্বখ্যাত এই বাংলাদেশি উদ্ভাবককে নিয়ে এবারের মূল রচনা লিখেছেন ইফতেখার মাহমুদ

‘আমি তখন ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ি। বাবা বুড়িগঙ্গার পারে কামরাঙ্গীরচরে এক খণ্ড জমি কিনলেন। সেখানে একটি ঘরও তৈরি করলেন। আমি প্রায়ই সেখানে যেতাম। নিজের উদ্যোগেই ঘরের এক কোণে একটি গবেষণাগার তৈরি করলাম। বিভিন্ন উদ্ভিদের লতাপাতা এনে একটার সঙ্গে আরেকটা মিলিয়ে দেখতাম, কী হয়। প্রাণরসায়ন নিয়ে গবেষণায় হাতেখড়ি আমার সেখান থেকেই।’ সোনালি আঁশ পাটের জিন-নকশা উন্মোচনকারী দলের নেতা প্রবাসী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম বলছিলেন প্রাণরসায়ন নিয়ে তাঁর গবেষণার শুরুর গল্প। হ্যাঁ, শুরুটা এ রকম সাদামাটাভাবেই।
কামরাঙ্গীরচরের ওই টিনের তৈরি ছোট্ট শখের গবেষণাগার থেকে মাকসুদুল আলম পৌঁছে গেছেন রাশিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র হয়ে মালয়েশিয়ার বড় বড় গবেষণাকেন্দ্রে। পেঁপে, রাবার ও সর্বশেষ পাটের মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের জীবনরহস্য উন্মোচন করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এই গবেষক। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী জার্নাল ন্যাচার মাকসুদুল আলমকে নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাঁকে ‘বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
১৬ জুন মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের সংবাদ শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করেছে। পাট নিয়ে একই ধরনের গবেষণা করছে এমন প্রতিযোগী দেশগুলোর গণমাধ্যমে সংবাদটিকে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে দেশের বিজ্ঞানীদের সমালোচনা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মাকসুদুল আলম ও তাঁর দলের এ সাফল্য দিয়েছে বাংলাদেশের সোনালি আঁশের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার সুখবর।

ঢ্যাঁড়স দিয়ে শুরু
জিন নকশা উন্মোচনে মাকসুদুল আলমের আগ্রহের শুরুটা হয়েছিল ঢ্যাঁড়স থেকে। গল্পটা শোনা যাক তাঁর কাছ থেকেই, ‘একবার দেশে প্রচণ্ড বন্যা হলো। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বাবা আমাদের জমিতে ঢ্যাঁড়সের বীজ লাগালেন। কয়েক মাস পর দেখলাম, সেখানে বিশাল আকৃতির ঢ্যাঁড়স হয়েছে। এত বড় ঢ্যাঁড়স আগে কখনো দেখিনি। অবাক হয়ে ভাবলাম, বন্যার আগেও তো বাবা ঢ্যাঁড়সের চারা রোপণ করেছিলেন। কিন্তু এবার এত বড় আকৃতির ঢ্যাঁড়স কীভাবে হলো? এই গভীর রহস্যময় আচরণ আমাকে ভাবিয়ে তুলল। ভাবলাম, নিশ্চয়ই এখানে মাটি, পানি ও বীজের মধ্যে এমন কোনো সমন্বয়ের ব্যাপার আছে, যা ফসলের চেহারা ও আকৃতি একেক সময় একেক রকম করে। কী করলে সারা বছর ও সব জায়গায় একই রকমের উন্নত ফসল পাওয়া সম্ভব, তা অনুসন্ধান করতে থাকলাম। এভাবেই রহস্য উন্মোচনের পথে আমার যাত্রা শুরু।’

পিলখানা থেকে হাওয়াই
মাকসুদুল আলমের জন্ম ফরিদপুরে। সালটা ১৯৫৪। বাবার বিডিআরে চাকরির সূত্রে ঢাকা পিলখানাতেই কেটেছে শৈশব-কৈশোর। ছোট ভাইয়ের শৈশবের কথা বলতে গিয়ে মেজর জেনারেল (অব.) মনজুরুল আলম (বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম্যান) বলছিলেন, ‘পিলখানার খেলার মাঠে বিকেলবেলা সব ছেলেপেলের দল হইহুল্লোড় করে খেলাধুলা করত। মাকসুদুল সবার সঙ্গে যোগ দিলেও মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যেত কোথায় যেন। অনেক খুঁজে তাকে শেষে পাওয়া যেত কোনো গাছগাছালি অথবা লতাপাতার সামনে। লতাগুল্ম নেড়ে নিবিষ্ট মনে কী যেন দেখছে মাকসুদুল। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটত।’ এভাবেই কাটছিল ছোটবেলা। এর মধ্যেই এল একাত্তর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম সপ্তাহেই পাকিস্তানি বাহিনী মাকসুদুলের বাবা দলিলউদ্দিন আহমেদকে ধরে নিয়ে যায়। সে বছরের ৩ এপ্রিল পিলখানার এক কোনায় বিডিআরের বেশ কয়েকজন সদস্যকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। সেখানে দলিলউদ্দিনও ছিলেন।
ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে মাকসুদুল উচ্চশিক্ষা নিতে চলে যান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে অণুজীববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি শেষ করেন। মাকসুদুল তাঁর দ্বিতীয় পিএইচডি করেন জার্মানির ম্যাক্স প্লানক ইনস্টিটিউট থেকে। এরপর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৯৭ সালে পান এনআইএইচ শ্যানান অ্যাওয়ার্ড। অণুজীববিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। ২০০১ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোর্ড অব রিজেন্টস এক্সেলেন্স অব রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।

মায়ের সংগ্রাম
বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরলেন মা লিরিয়ান আহমেদ। মাত্র নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন তিনি। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। এই নারী তাঁর আট সন্তানকে একদিন ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।’ মায়ের সেদিনকার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন সন্তানেরা।

কাপড় সেলাই করাকে পেশা হিসেবে নিয়ে মা লিরিয়ান আহমেদ সংসারের খরচ চালাতেন। মাকসুদুল ও তাঁর বড় ভাই মনজুরুলসহ চার ভাই ও চার বোনের সবাই টিউশনি করে নিজেদের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেন। মায়ের নিরলস সংগ্রাম আর সাধনার গুণেই সংসারে সুদিন এল একদিন। সবার বড় বোন শামসুন নাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে যোগ দিলেন। অন্য ভাই-বোনদের উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব নিলেন। পাটের জিন-নকশা উন্মোচনকারী এই বিজ্ঞানী নিজের জীবনের সাফল্যের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে বললেন, ‘নিজের গায়ের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে দিলেও আমার বড় বোনের ঋণ শোধ হবে না। তিনি আমার জন্য যা করেছেন, তা না পেলে আমার পক্ষে এত দূর আসা সম্ভব হতো না।’ বলতে না বলতেই তাঁর চোখ জলে ছলছল। মায়ের কথা বলতে গিয়ে আবেগ আর চোখের জলে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল আবারও। ‘সব ভাই-বোনকে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত করে বিয়ে দিয়ে মা মারা গেলেন ১৯৯৮ সালে। ঠিক বাবার মৃত্যুর দিন, ৩ জুন।’ বলে একটু থামলেন মাকসুদুল। তারপর বললেন, ‘একজন সচেতন মা পারেন একটি শিক্ষিত জাতি তৈরি করতে। আমার মা পড়াশোনা কম জানলেও তিনি শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। বাংলাদেশকে বিজ্ঞানে এগিয়ে নিতে হলে নারীদের বিজ্ঞানমুখী করতে হবে। তারাই মা হয়ে তার সব সন্তানকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে পারবে। ফলে এর প্রভাব হবে বহুমুখী। এই যেমন, মালয়েশিয়ার ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বেশি এগিয়ে।’

সোনালি আঁশের সোনালি আশা
‘যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পেঁপের জীবনরহস্য উন্মোচনের (জেনোম সিকোয়েন্সিং) সময় আমার শুধু আফসোস হয়েছে দেশের জন্য কিছু করতে পারলাম না বলে। সুযোগ পেলে আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজনীয় শস্য ও ফসলের জিন-নকশা উন্মোচন করার সাধ তখন থেকেই ছিল।’ পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের আগ্রহের শুরুর গল্প বলছিলেন মাকসুদুল।
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই রাজ্যের প্রধান ফসল পেঁপে। জিন-নকশা উন্মোচনের পর তাঁরা বেশ কিছু নতুন জাত উদ্ভাবন করলেন। পেঁপের বেশ কিছু রোগ হতো। পোকার আক্রমণে প্রচুর পেঁপে নষ্ট হতো। কৃষক বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হতো। উন্নত জাত উদ্ভাবন করে কৃষকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার পর তাদের ভাগ্য বদলে গেল। পেঁপের উৎপাদন বহুগুণে বেড়ে গেল। হাওয়াই রাজ্যের কৃষি-অর্থনীতির চেহারাই পাল্টে গেল। মনে হচ্ছিল, নিজের দেশের ধান, পাট, বনজ ঔষধি গাছগুলোর জিন-নকশা উন্মোচন করা গেলে দেশের কৃষির চেহারা পাল্টে দেওয়া সম্ভব হতো।
২০০৮ সালের শেষের দিকে মালয়েশিয়া সরকার জিন-নকশা নিয়ে গবেষণা করার জন্য একটি বড় গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করে। সেখানে মাকসুদুলের ডাক পড়ল রাবারের নিয়ে গবেষণা করার জন্য। তাঁর সঙ্গে হাওয়াই থেকেও কয়েকজন যোগ দিলেন। ২০০৯ সালের নভেম্বরের মধ্যেই তাঁরা রাবারের জেনোম সিকোয়েন্সিং উন্মোচন করে ফেললেন। তখন আরও বেশি করে দেশের জন্য কাজ করার আগ্রহ বোধ করলেন। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। প্রাণরসায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন এমন বন্ধুরা শুনেই উৎসাহ দেখালেন। তাঁরা বললেন, যেকোনো মূল্যে এটা হতেই হবে, তাঁরাই পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করবেন।
২০০৮ সালের জুন মাসে তৈরি হলো স্বপ্নযাত্রা নামের একটি উদ্যোগ। প্রবীণ-নবীন মিলিয়ে ৭২ জন বিজ্ঞানী ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ যোগ দিলেন সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান ও জেবা সিরাজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী যোগ দিলেন। নিজেদের অর্থ ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে তাঁরা কাজ শুরু করলেন। পাটের জিনের প্রায় দুই কোটি তথ্য হাতে চলে এল। কিন্তু বাধা এল এর পরপরই। সে বাধা কাটিয়েও ওঠা গেল।
‘গবেষণার একটি পর্যায়ে গিয়ে টাকার কারণে আটকে গেলাম। প্রথম আলোতে আমাদের গবেষণা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ফোন করলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করলাম। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে অর্থসহায়তা দেওয়ার ঘটনা আমাদের হতাশা কাটিয়ে সাফল্যের দিকে নিয়ে গেল।’ বলছিলেন মাকসুদুল আলম।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে অর্থসহায়তা দেওয়ার পর ৩ জানুয়ারি আরও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হলো। গবেষণা শুরুর আগে সবাই লিখিতভাবে চুক্তিবদ্ধ হলেন পুরো গবেষণা শেষ হওয়ার আগে কেউ কোনো তথ্য বাইরে কারও কাছে বলবেন না। গবেষকদলের ৪২ জন সদস্যের সবাই তা মেনে চলেছেন। মাকসুদুল আলমসহ গবেষকদের কেউই এ গবেষণার জন্য পারিশ্রমিক নেননি। গবেষকদের সবার পরিচয়ই গোপন রাখা হয়েছে।
তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ—১৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানালেন সুখবর—পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে ছাপা হলো এই উদ্ভাবনের খবর।

পাটের জিনোম বদলে দেবে বাংলাদেশকে
পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের প্রধান কৃতিত্ব তরুণ গবেষকদের দিতে চান মাকসুদুল আলম।
গবেষণাটি সফলভাবে শেষ করতে নিজেদের ব্যক্তিগত অনেক বিষয়ে তাঁদের ছাড় দিতে হয়েছে।
গবেষণা চলাকালে একজন সহযোগী গবেষকের মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মাকে হাসপাতালে রেখে তিনি প্রতিদিন তাঁর গবেষণার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মা মারা যাওয়ার তিন দিনের মাথায় আবারও কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
সবাইকে দিনরাত পরিশ্রম করে কাজ করতে হয়েছে।
পাটের পর তুলসীসহ নানা দেশি ঔষধি গাছের জিন-নকশা উন্মোচন করতে চান মাকসুদুল আলম। দেশের প্রাণরসায়নবিজ্ঞানীদের উন্নীত করতে চান বিশ্বমানে।
এ জন্য তরুণ গবেষকদের দেশে ধরে রাখাটাকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।
আর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, যদি তরুণদের জন্য গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, তবে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না বাংলাদেশকে।
Source: Daily Prothom-Alo

Thursday, January 13, 2011

পাটের জিনোম বদলে দেবে বাংলাদেশকে

পাটের জিনোম বদলে দেবে বাংলাদেশকে- ড. জন ক্রিস ডিটার, জিনোম সায়েন্স গ্রুপ লিডার
এক নজরে

ড. ডিটার
গ্রুপ লিডার
জেনোমিকস গ্রুপ (এলএএনএল)
কেন্দ্রীয় পরিচালক
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি, জয়েন্ট জিনোম ইন্সস্টিটিউট
পরিচালনা পর্ষদ সদস্য
দ্য অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যাবরেটরি অটোমেশন
সদস্য
আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য এডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স
চেয়ারম্যান
সিকোয়েন্সিং, ফিনিশিং এন্ড অ্যানালাইসিস ইন দ্য ফিউচার (এসএফএএফ) শীর্ষক আন্তর্জাতিক বার্ষিক সভা

প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গত ২৫ জুন মাত্র একদিনের জন্য বাংলাদেশে আসেন জিনোম সায়েন্স ও লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির জেনোমিকস (এলএএনএল)-এর গ্রুপ লিডার ড. জন ক্রিস ডিটার। সেদিন তিনি সিলেটের শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখেন। শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার নিয়ে সন্ধানীকে জানিয়েছেন তাঁর অভিমত

প্রথমেই জানতে চাইব জিন নকশা উন্মোচনের দরকারটা কী?
জিন নকশা উন্মোচনকে বলা যায় 'ঋরহফরহম ঃযব নঁরষফরহম নষড়পশ ড়ভ ষরভব'। কোনো জীবের জিনোম বলতে ওই জীবের বংশানুক্রমিক তথ্যের সমষ্টিকে বোঝায়, যা তার ডিএনএতে সংকেত আকারে থাকে। জীবনের জন্য প্রয়োজন প্রোটিন। আর তা কী করে কখন-কোথায় বানাতে হবে তার নির্দেশনা থাকে ডিএনএতে। আর সেই বার্তা বহনকারী উপাদানটি হচ্ছে আরএনএ। জীবের প্রথম মাতৃকোষেই লেখা থাকে ডিএনএর বিন্যাস। কোনো জীবকে বুঝতে হলে ওই জীবের জিনের সেই বিন্যাস জানতে হবে।

সদ্য আবিষকৃত পাটের জিন বিন্যাস কিভাবে কাজে আসবে?
জানতে পেরেছি, পাটকে এখানে সবাই সোনালি আঁশ বলে। এই জিন নকশা উচ্চ ফলনশীল পাটের জাত তৈরিতে সাহায্য করবে। মোটা আঁশ, আকারে বড়, স্বল্প সময়ে ফসল আসবে_এমন পাটও আসতে পারে অচিরেই। এ ছাড়া আশা করি, পোকার আক্রমণ, বন্যা ও খরাসহিষ্ণু নতুন পাটের জাত তৈরিও সম্ভব হবে। পাট শুধু কৃষকের নয়, শিল্প-কারখানাসহ প্রায় সবারই কাজে আসে। তা ছাড়া পরিবেশবান্ধব জ্বালানি তৈরিতেও কাজে আসবে। তবে এই জিন নকশা উন্মোচন করে থেমে গেলে চলবে না। এই জিন নকশার ভিত্তিতে আরো গবেষণা করে তার প্রতিফলন মাঠে দেখাতে হবে। গবেষণা শুধু ল্যাবরেটরিতে আটকে থাকলে চলবে না। এ ব্যাপারে আমি বেশ আশাবাদী। বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা ভালো করবেনই। শুধু পাট নয়, অন্য ফসল নিয়েও তাঁরা কাজ করবেন এবং উন্নতি করবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। পাটের জিনোম বদলে দেবে বাংলাদেশকে।

বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই উদ্ভাবন কতটা গৌরবের?
বাংলাদেশে তৃতীয় বিশ্বের দেশ হলেও জ্ঞান-বিজ্ঞানে মোটেও পিছিয়ে নেই। এ দেশের তরুণ বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। এ জন্য আমি তাঁদের সম্মান করি। এই কাজের জন্য আমার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের জন্য শুভেচ্ছা রইল। বিশেষ করে ড. মাকসুদুল আলম, ড. হাসিনা খান, ডাটা সফট এবং সব বিজ্ঞানী, যাঁরা এই কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, সবাইকে শুভেচ্ছা। বিশ্বে জিন নকশা উন্মোচন করেছে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ। বাংলাদেশ যে তাদের দলে নাম লেখাতে পেরেছে এটা খুবই আনন্দের বিষয়। ড. মাকসুদুল আলম কিন্তু আরো দুটি জিন নকশা উন্মোচনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে এই কাজে তরুণ বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি। অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ওই তরুণদের অংশগ্রহণের জন্যই, আমি মনে করি, এ কাজ এত দ্রুত সম্ভব হয়েছে। কেননা জিন নকশা উন্মোচন মোটেই সহজ নয়। এ পর্যন্ত মাত্র ১৬টি উদ্ভিদের সম্পূর্ণ জিন নকশা উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এটি অবশ্যই গর্বের বিষয়।

বিশ্বে বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের অবস্থান কেমন?
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের অনেক চাহিদা আছে। তাঁরা অত্যন্ত পরিশ্রমী। এ জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের খুবই পছন্দ করি। আর এই বিজ্ঞানীদের যেকোনো প্রয়োজনে আমি ব্যক্তিগতভাবে পাশে থাকব।

বাংলাদেশে এসে কেমন লাগল ?
খুব সুন্দর দেশ। বিশেষ করে এদেশের আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন

আল নাঈম চৌধুরী
Source: Daily Kalerkantho

Tuesday, January 11, 2011

জিন-নকশার উন্মোচনে বদলে যাবে পাট

জিন-নকশার উন্মোচনে বদলে যাবে পাট

২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের সোনালি আঁশের জিন-নকশা উন্মোচনের কথা বলে আসছে বিজ্ঞান প্রজন্ম। অবশেষে সেই পাটের জিন-নকশা উন্মোচিত হলো বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে বাংলাদেশেরই একঝাঁক নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানকর্মীর হাতে। এ নিয়ে বিশেষ আয়োজন

এ গল্পের শুরুটা নানাভাবে হতে পারে। এটির শুরু হতে পারে হাওয়াই দ্বীপের পেঁপের জিন-নকশা উন্মোচনে কিংবা মালয়েশিয়ায় রাবারের একই ঘটনায়। তবে আমরা যদি চাই, তাহলে এ গল্পের শুরু হতে পারে একজন পাদ্রির কৌতূহল নিয়ে। পাদ্রি গ্রেগর জোহান মেন্ডেল জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা করছিলেন। লম্বা আর খাটো মটরশুঁটির বৈশিষ্ট্য কীভাবে বংশ-বংশানুক্রমে প্রবাহিত হয়, সেটি জানতে গিয়ে তিনি সূচনা করেন এক নতুন বিজ্ঞানের। তাঁর হাত ধরে মানুষ জানতে পারে, দেখতে যেমনই হোক, বহিরাবরণে যা-ই থাক, জীবনের বৈশিষ্ট্যেরও একক আছে। তাঁর রকমফের থেকে জীবনের নানা প্রকাশ। পাদ্রি মেন্ডেলের এই বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড সেভাবে কারও নজরে আসেনি। শখানেক বছর পর নতুনভাবে আমরা তাঁর কথা জানলাম। আস্তে আস্তে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেতে শুরু করল বংশগতির বিজ্ঞান। আমরা জানলাম, জীবনের বৈশিষ্ট্যের একক হলো জিন, আর সেই বিজ্ঞান হলো জেনেটিকস।

তারপর আবার একটি লাফ। ৫০ বছর পর, আমাদের গল্পের নতুন এপিসোডের জোড়া নায়ক ওয়াটসন আর ক্রিক। দুজনের হাত ধরে আমরা জেনে গেলাম, জিনমাত্রই আসলে একধরনের এসিডের চাঞ্চল্য। নিউক্লিক এসিড (ডি-অক্সিরাইবো বা রাইবো)। পুরোটা বললে ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড ও আরএনএ (রাইবো নিউক্লিক এসিড)। ডিএনএর কাজ হলো, জীবনের জন্য কী ধরনের প্রোটিন বানাতে হবে, সেটির নির্দেশনা ধরে রাখা। আর আরএনএর কাজ হলো, সেই বার্তাটা বয়ে নিয়ে যাওয়া। তার মানে দাঁড়াল, জীবন শেষ বিচারে ডিএনএ বা আরএনএর দৌড়ঝাঁপ। একজন মানুষের চোখের রং নীল হবে না কালো হবে, তার তথ্যটি প্রথম মাতৃকোষেই লেখা থাকে! লেখা থাকে ডিএনএর দ্বিসূত্রকের বিন্যাসে। মাতৃকোষের বিভাজন থেকে শরীর গঠনের একপর্যায়ে চোখ গঠিত হয়। তখন আদি কোষের ডিএনএন থেকে আরএনএ নীল চোখের বার্তা পৌঁছে দেয় সেখানে। আমরা দেখি নীল নয়নাকে।

এভাবে আসলে সব জীবকোষের সব বৈশিষ্ট্য সঞ্চিত আছে জিনে। মোদ্দাকথা, কোনো জীবের জীবনকে বুঝতে চাও, তার জিনের অনুক্রম বা বিন্যাসটা জেনে নাও।

জিনবিজ্ঞানের মূল বিষয়টি আসলে এটাই। জীবনরহস্যের সমাধান জিন-নকশা।

এবার আমরা আমাদের গল্পে একটি বিরতি নিই। আমরা ফিরে আসি আমাদের জন্মভূমিতে, এই বাংলায়।

বাংলার কৃষকের হাত ধরে বিকশিত হয়েছে নানা জাতের ধান। এর কোনোটি লবণ সহ্য করতে পারে, কোনোটি বন্যার পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে, কোনোটি অল্প দিনে ফসল দিতে পারে। মেন্ডেল আর ক্রিকের বুদ্ধি দিয়ে আমরা বলতে পারি, এগুলোর আলাদা বৈশিষ্ট্যের কারণ যে জিন, সেগুলো প্রকাশিত। নানা ধরনের বৈশিষ্ট্যের ধান থেকে আমরা বাছাই করতে পারি আমাদের যেমনটি চাই, মোটামুটি সে ধরনের কিছু। সেগুলোকে আমরা নিয়ে যেতে পারি মাঠে। তাদের মধ্যে আমরা মুক্ত ব্রিডিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারি, ঠিক যেমনটি মেন্ডেল করেছিলেন, তবে আরও আধুনিকভাবে। ফল হিসেবে আমরা উচ্চফলনশীল ধান পেয়ে যাব। পেয়েছিও। ষাটের দশক থেকে শুরু হওয়া আমাদের ধানবিপ্লবে, ধান নিয়ে আমাদের ষাট-সত্তর-আশির দশকের বিপ্লবের মূলে ওই ব্রিডিংই।

ধানের কথা বললে আসে আমাদের সোনালি আঁশের কথা! পাট কেন সোনালি, স্বর্ণের রং বলে! পাঠক, আমাকে মারতে আসবেন। কারণ পাট তো দেখতে স্বর্ণালি নয়। তবুও কেন সে সোনার উপমা। কারণ আর কিছুই নয়, পাটের অর্থমূল্য। বাংলার মাটি পাট চাষের উপযোগী। পাটপণ্যের চাহিদা একসময় ছিল বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ফলাফল পাটের এ অঞ্চলের, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল হয়ে ওঠা। পাট হয়ে ওঠে আমাদের জন্য সোনার উপমা, স্বর্ণালি আশা।

সব আশার সঙ্গে নিরাশাও থাকে। উন্নত বিশ্বে হঠাৎ করে আবির্ভূত হয় প্লাস্টিক পণ্য, পলিথিন, কৃত্রিম তন্তু। রাতারাতি পরিবেশবান্ধব পাট হারিয়ে যায়। আমাদের পাটও হারিয়ে ফেলে তার স্বর্ণচ্ছটা। তবে দিনের আবার বদল হয়। মানুষ টের পেয়ে যায়, তার উৎপাদিত প্লাস্টিক পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে ফেলছে। শুরু হয় আবার পরিবেশবন্ধুর সন্ধান। উঁকি দেয় ফের পাটের স্বর্ণালি আশা।

তবে তত দিনে পদ্মার জল গড়িয়েছে অনেক। পুরোনো পাটে কিন্তু পারা যাবে না সবার সঙ্গে, বিশেষ করে প্লাস্টিকের সঙ্গে। চাই নতুন পাট। কেমন সেটা? যেমন আমাদের ধবধবে পাটের জাত। এটিতে লিগানিন কম। ফলে তন্তুটা ভালো, মিহি। কিন্তু ঝামেলা হলো, এটি বড়ই স্পর্শকাতর। পোকার আক্রমণ মোটেই সহ্য করতে পারে না।

অথবা পোকার আক্রমণ ঠেকাতে পারে এমন পাট। কিন্তু সেটিতে লিগানিন বেশি। পচানোর জন্য জাগ দিতে হয়, প্রচুর পানি লাগে। কাজেই লিগানিন কমওয়ালা পাট দরকার। কীভাবে পাওয়া যাবে? ধানের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ভাবলাম, প্রকৃতিতেও নিশ্চয়ই এমন পাট আছে। আমাদের কাজ হবে একটির বৈশিষ্ট্য আরেকটিতে ঢুকিয়ে দেওয়া। আর তা করতে গিয়েই আমরা পড়লাম বিপদে। কারণ, ধানের মতো হাজার জাতের পাট যে নেই! হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি জাতের পাট। কাজেই কেমন করে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আমরা পাব?

বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও ভাবেন। উন্নত জাতের পাটের উদ্ভাবন কেমন করে হবে। ঢাকার পাট গবেষণাগারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে কিংবা আলোচনায়, টেক্সাসের গবেষণাগারে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী—সবাই ভাবেন। আর শেষ পর্যন্ত তাঁরা ফিরে আসেন মেন্ডেল-ওয়াটসন আর ক্রিকের গল্পে। আমরা বুঝতে পারি, উন্নত জাতের পাট পেতে হলে আমাদের জানতে হবে পাটের মুক্ত বৈশিষ্ট্যের রহস্য, এর জিন-নকশা। পুরো জিন-নকশা জানার পর আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারব তার সদস্যদের চেনার কাজে। কোন জিন বাবাজি লিগানিনের প্রাবল্যের জন্য দায়ী, কোন জিনের অনুপস্থিতির জন্য বেচারা ধবধবে পাট হেরে যায় পোকার কাছে। যদি আমরা সেটা জানতে পারি, তাহলেই আমরা আমাদের স্বপ্নের পাট পেয়ে যাব। এটা শুধু যে বাংলাদেশ জানল তা নয়, জানল পাট উৎপাদনকারী সব দেশই। শুরু হলো এক নতুন, অদৃশ্য লড়াই। কে সবার আগে এই জিন-নকশা উন্মোচন করবে। এবার আমরা পাটের গল্প থেকে ‘একটি ছোট্ট বিরতি’ নিই।

জিন-নকশা উন্মোচনের কাজটি সহজ নয়। এর আগে মাত্র ১৬টি উদ্ভিদের সম্পূর্ণ জিন-নকশা উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয় হলো, এর মধ্যে দুটোই হয়েছে এক কীর্তিমান বাঙালির হাত ধরে। তাহলে তো কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল, তাই না। বাংলাদেশের পাটের জিন-নকশা উন্মোচিত হবে বাঙালি বিজ্ঞানীরই হাতে। ফরিদপুরের বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের হাতেই তবে হোক আমাদের সোনালি আঁশের সোনালি দিনের আহ্বান।

এ গল্পের পরের একটি এপিসোড এখন সারা বিশ্বের সবারই জানা। বাংলাদেশ সরকারের অর্থানুকূল্যে মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে পাটের জিন-নকশা উন্মোচিত হয়েছে।

জিন-নকশার এই উন্মোচন দুটি নতুন আলো দেখিয়েছে। প্রথম আলোর কথা আমি বলেছি শুরুতে। নতুন উন্নত জাতের পাট। কাজটি হবে ফাংশনাল জেনোমিকসের হাত ধরে। প্রথমে পাটের জিনগুলোর কোনটি কোন বৈশিষ্ট্যের, সেটি জানার মাধ্যমে। এর পর করতে হবে তার ব্যঞ্জনা। কোনটি থাকবে, কোনটি থাকবে না—কীভাবে কেটে, কীভাবে সাজালে আমরা পেয়ে যাব স্বপ্নের পাট। দীর্ঘ ও লম্বা সময়ের কাজ। হয়তো বছর পাঁচেক লেগে যেতে পারে।

দ্বিতীয় যে আলো দেখিয়েছে এই প্রকল্প, তা আমাদের নতুন প্রজন্মের আলো। আমাদের নতুন প্রজন্মকে এ কাজে যুক্ত করা তাদের গড়ে তোলা। সেটিও হয়েছে সার্থকভাবে। আমরা দেখেছি, যে কাজের জন্য অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন, সে কাজ আমাদের নতুন প্রজন্ম করেছে কাজ করতে করতে। এই নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে গড়ে উঠবে আমাদের বায়োটেকনোলজির নতুন ভুবন। তথ্যপ্রযুক্তি আর বায়োটেকনোলজির হাতে হাতে ধরে রচিত হবে আমাদের দিনবদলের নতুন কাব্য। এর কোনটিতে মূখ্য হবে পাট বা ধান, কোনটি জুড়ে থাকবে নতুন কোন প্রাণরক্ষাকারী ওষুধ।

আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।

সংগ্রহ: প্রথম-আলো
মুনির হাসান, তারিখ: ২০-০৬-২০১০

Monday, January 10, 2011

বর্ষসেরা দেশি আবিষ্কার

বর্ষসেরা দেশি আবিষ্কার

প্রতি বছরই ইউরোপ ও আমেরিকার বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের ভারিক্কি সব আবিষ্কার স্থান পায় টাইম ম্যাগাজিনের তালিকায়। কিন্তু ওই তালিকার চেয়েও আমাদের জন্য এখন বেশি জরুরি_পাটের জিন সিকোয়েন্স কাজে লাগিয়ে বড় কিছু করা, বিকল্প জ্বালানির সাশ্রয়ী উৎস খোঁজা। আর এ বছর দেশে এসব নিয়েই হয়েছে নিরলস গবেষণা, এসেছে চমকপ্রদ সব সাফল্য। চলতি বছরে বিজ্ঞানে আমাদের সেরা কয়েকটি অর্জন নিয়েই সন্ধানীর বিশেষ আয়োজন
পাটের জিন নকশা
এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা সোনালি আঁশ পাটের পূর্ণাঙ্গ জিন নকশা উন্মোচন করে সারা বিশ্বের বিজ্ঞান মহলে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছেন।
গবেষণাটির নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণরসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষক ড. হাসিনা খান। তাঁদের নেতৃত্বে কাজ করছেন দেশের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় কিছু তরুণ গবেষক। উপাত্ত ভাণ্ডার সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণে সহায়তা করেছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডাটা সফট। আর ছিল বাংলাদেশ সরকারের অকুণ্ঠ সমর্থন ও অব্যাহত সহযোগিতা। পাটের জিন নকশা উন্মোচন মৃতপ্রায় পাটশিল্পকে শুধু পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনাই দেখায়নি, পাশাপাশি বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বিজ্ঞান গবেষণায় স্থাপন করেছে নতুন মাইলফলক। প্রয়োজনীয় সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা পেলে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা যে সারা বিশ্বকে তাক লাগানোর মতো আবিষ্কার করতে পারেন তাই প্রমাণ করেছে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এ জিন নকশা উন্মোচন। এটি উচ্চফলনশীল পাটের জাত তৈরিতে সহায়তা করবে। মোটা আঁশ, আকারে বড়, স্বল্প সময়ে ফসল আসবে এমন পাটও আসতে পারে অচিরেই। পোকার আক্রমণ, লবণাক্ততা, বন্যা ও খরাসহিষ্ণু নতুন পাটের জাতও তৈরি সম্ভব হবে। এ ছাড়া পরিবেশবান্ধব জ্বালানি তৈরিতেও কাজে লাগবে। বিশ্বে জিন নকশা করতে পেরেছে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ। এ পর্যন্ত মাত্র ১৬টি উদ্ভিদের জিন নকশা উন্মোচিত হয়েছে।

জুটিন
প্রচলিত টিন ব্যয়বহুল, আমদানিনির্ভর এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। পরিবেশের কথা মাথায় রেখেই বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের একদল বিজ্ঞানি সোনালি আঁশ পাট ব্যবহার করে উদ্ভাবন করেছেন নতুন ধরনের টিন জুটন। এর প্রধান কাঁচামালই হচ্ছে পাট। গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ড. মোবারক হোসেন খান।
লবণাক্ত পানিতে ক্ষতি হবে না এই টিনের। নষ্ট হয়ে গেলে মাটিতে পুরোপুরি মিশে যাবে। স্থায়িত্ব এক শ বছরেরও বেশি। এতে কোনো ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ ব্যবহার করা হয় না, তাই মরিচাও ধরবে না। ভেতরে চটের স্তর থাকায় এর মধ্যে দিয়ে তাপ পরিবাহিত হবে না। ফলে ঘর ঠাণ্ডা থাকবে। আর সাধারণ টিনের মতো এটি ধারালো নয়। ঘরের চাল, দেয়াল, টয়লেটের কমোড, চাক ও চেয়ার তৈরিতে এর ব্যবহার সফল হয়েছে।

পাট বাঁচাবে মাটির ঘর
ফ্রান্সে এমন সব নান্দনিক বাড়ি বানানো হচ্ছে যা দেখে আশ্চর্য হবেন যে কেউ। আর আমাদের দেশের গ্রামেগঞ্জে মাটির বাড়ি বহুল প্রচলিত। বাড়ি বানানোর সময় যদি মাটির সঙ্গে পাটের আঁশ মেশানো হয়, তবে বাড়িটি হবে অনেক দৃষ্টিনন্দন ও টেকসই। এ বছর জাপানের সাইতামা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের যৌথ গবেষণায় পাওয়া গেছে এ তথ্য। পাটের আঁশগুলো যদি ২-৩ সেমি লম্বা টুকরা করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় তাহলে শুকানোর সময় কোনো ফাটল তৈরি করবে না। পাটের তৈরি ‘প্রটেক্টিভ কোটিং’ ঘরকে সহজেই বৃষ্টি-বাদল-ঝড় থেকে রক্ষা করবে। এটি ঘরকে ভূমিকম্প প্রতিরোধে সহায়তা করবে। পাশাপাশি এভাবে তৈরি ঘর পরিবেশবান্ধব, খরচ অল্প এবং সহজেই তৈরি করা যায়।

পাট থেকে জুতার সোল
বর্তমানে জুতার সোলে শু গ্রেডেড পিভিসি ব্যবহার করা হয়। এর কাঁচামাল আমদানিনির্ভর এবং খরচও বেশি। এর বিকল্প হিসেবে এ বছর পাটের তৈরি বিশেষ কম্পোজিট পদার্থ থেকে জুতোর সোল তৈরি করেছেন বুয়েটের ছাত্র তৌসিফ আহমেদ ও ঈশান খান। তাদের গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. মাকসুদ হেলালী। পাটের তৈরি কম্পোজিট থেকে উদ্ভাবিত জুতার সোলের খরচ ২০ ভাগ কম। ২০ শতাংশ পাটের আঁশের আর ৮০ শতাংশ পিভিসি দিয়ে বুয়েটের ল্যাবে তৈরি কম্পোজিট থেকে এই নতুন ধরনের জুতার সোল আবিষ্কার করেন তাঁরা।

জলে ডুববে না যে নৌকা
ফরাসি গবেষক ইভ মার ও শিল্পপতি আবুল খায়ের লিটুর যৌথ উদ্যোগে ১০ বছর আগে সাভার পৌর এলাকায় কাতলাপুরের বংশী নদীর তীরে গড়ে ওঠে ‘তাড়াতাড়ি’ শিপইয়ার্ড। বেঙ্গল জুট ইন্ডাস্ট্রিজের সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় পাট ও ফাইবার গ্লাসের সমন্বয়ে এ বছরেই তৈরি করেছে বিশেষ এক নৌকা। চাইলেও যা ডোবানো সম্ভব নয়। এমনকি উল্টে গেলেও ডুববে না। এতে চড়ে পাড়ি দেওয়া যাবে উত্তাল সমুদ্র। সাধারণ কাঠের নৌকার চেয়ে এর স্থায়িত্ব অনেক বেশি। নৌকাটির নকশা করেছেন ফরাসি প্রকৌশলী মার্ক ভ্যান পেইটেগেম। পালতোলা নৌকাটিতে ইঞ্জিনও আছে। পাট দিয়ে তৈরি বলে এটি পরিবেশবান্ধব।

Source: http://gunikanon.wordpress.com

Sunday, January 9, 2011

পাটের আঁশ ছাড়ানোর নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে

পাটের আঁশ ছাড়ানোর নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে নিজস্ব প্রতিবেদক পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কারের পর এবার কম পানিতে পাট পচিয়ে আঁশ ছাড়ানোর যন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। নতুন এ যন্ত্রের মাধ্যমে কাঁচা পাটের ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া হবে। পরে শুধু ছালই কম পানিতে ডুবিয়ে বিশেষ রাসায়নিকের মাধ্যমে পচানো হবে।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. সামিউল আলম গতকাল বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কারক দলের প্রধান ড. মাকসুদুল আলম বলেন, 'আমাদের দেশে অনেক মেধা রয়েছে। অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগসুবিধাও নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারিভাবে গবেষণায় অর্থায়নও করা হচ্ছে। ফলে আমরা অচিরেই আরো ভালো কিছু করতে পারব।' জীবনরহস্য আবিষ্কারে বাংলাদেশের প্রাপ্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশই বর্তমানে এ জীবনরহস্য আবিষ্কারের বিষয়ে কাজ করছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রইল। এর ফলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে উন্নত জাতের পাট উদ্ভাবন, পাটের বিভিন্ন জাত, উন্নত আঁশ এবং রোগ-সহিষ্ণু পাট আবিষ্কার করতে পারবে, যা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নে আরো কার্যকর হবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. মাকসুদুল আলমের পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কার নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে তরুণ গবেষকদের সংগঠন 'স্বপ্নযাত্রা'। এতে পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কারের সাত মাসের গবেষণায় নিয়োজিত ৩৫ তরুণসহ সব বিজ্ঞানী ও গবেষককে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় অনেকেই এ কাজে তাঁদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেন।
ড. মাকসুদুল আলম জানান, পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কারের সুফল কৃষক পর্যায়ে নিয়ে যেতে আরো পাঁচ বছরের মতো সময় লাগার কথা আমরা বলছি। কারণ, আমরা জনগণকে প্রতারিত করতে চাইনি। এত সময় নাও লাগতে পারে। এ জন্য আমরা দ্রুত কাজ করে যাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে তরুণ গবেষক দলের পক্ষ থেকে এ গবেষণায় জড়িত প্রত্যেকের জন্য কর্মসংস্থান ও গবেষণায় আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, অন্যথায় এসব বিজ্ঞানী ও গবেষককে জীবিকার তাগিদেই বিদেশে চলে যেতে হবে। দেশের মেধাবৃত্তিক এ গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত হবে।
Source: Daily Kalerkantho

স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে অর্থের নিশ্চয়তা চান গবেষকরা : পাটের জন্মরহস্য উদ্ভাবন বদলে দিতে পারে অর্থনীতি

স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে অর্থের নিশ্চয়তা চান গবেষকরা:
পাটের জন্মরহস্য উদ্ভাবন বদলে দিতে পারে অর্থনীতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পাটের জেনম সিকোয়েন্স (জন্ম রহস্য) বদলে দিতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। জেনম সিকোয়েন্সের বীজ দিয়ে পাট চাষ হতে পারে উপকূলীয় লবণাক্ত মাটিতেও। গড়ে তোলা যেতে পারে ওষুধ শিল্প। এই প্রযুক্তির পাটে রোগবালাই হবে না। খরা, বন্যার মাঝেও ফলন ঠিক থাকে। এসব লক্ষ্য সামনে রেখে শুরু হয়েছে সোনালি আঁশ পাটের জেনম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের স্বপ্নযাত্রা। এই স্বপ্নকে বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে গবেষকরা সরকারের কাছে জরুরী ভিত্তিতে অবকাঠামো এবং অর্থ সরবরাহের নিশ্চয়তা চেয়েছেন।
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সমবেত হয়ে তাঁরা সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশে মেধার ঘাটতি নেই। এখন যে সমস্যা দেখা দিতে পারে, তা হচ্ছে অবকাঠামো এবং অর্থের। পাটের জেনম সিকোয়েন্স উদ্ঘাটনের সুফল দেশের কৃষক সমাজে পৌঁছে দেয়াই এখন বড় একটি চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে এই রহস্য উদ্ঘাটনে জড়িত গবেষকদের অনুপ্রেরণা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যদিও সরকারের উদ্যোগেই সম্ভব হয়েছে পাটের জেনম সিকোয়েন্স। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর উদ্যোগের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
তবে কাজ এখনও অনেক বাকি আছে। গবেষণা দলের প্রধান ডক্টর মাকসুদুল আলম বলেছেন, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির কারণে বোম মারলেও আমি এই মুহূর্তে বলব না যে গবেষণা কাজের অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে। তবে এটুকু বলতে চাই, আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এই গবেষণার পূর্ণাঙ্গ ফল এবং কৃষকদের হাতে জেনম সিকোয়েন্সের উদ্ভাবিত বীজ পৌঁছে দিতে সবের্াচ্চ ৫ বছর সময় লাগবে। কারণ এখনও খুঁটিনাটি অনেক কাজ বাকি আছে। দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেও এটা সম্ভব হতে পারে। তবে সময় নির্দিষ্ট করা যাবে না। এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে অর্থের নিশ্চয়তা। সরকার আমাকে বলেছে, করো এবং প্রয়োজনীয় বৈধ কাগজপত্রও আমাকে সরবরাহ করা হয়েছে। তবে অর্থের গ্যারান্টি এখনও পাওয়া যায়নি। আমাদের মেধার অভাব নেই। গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু অবকাঠামো সমস্যা আছে। এটা ঠিক করা প্রয়োজন। এর সঙ্গে অর্থের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে উপস্থিত হন ডক্টর মাকসুদুল আলমসহ গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত তরম্নণ গবেষকবৃন্দ। তারা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে এই গবেষণা চালান। এদের মধ্যে দশজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকুলার বায়োলজির ছাত্রছাত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক দলের সদস্য শারমিন শাম্য গবেষণার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশপ্রেমের কারণে পাটের জন্ম রহস্য উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। কখনও দেখা গেছে বিদু্যতের অসহ্য লোডশেডিং। তারপরও এই কাজটি করতে তারা গর্ববোধ করেছেন। তারা বিশ্বাস করেছেন একদিন তাদের এই গবেষণা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে। তারা এই গবেষণাকে চূড়ান্ত রূপ দিতেও অঙ্গিকারাবদ্ধ। তবে তার জন্য সরকার ও বেসরকারী খাতের উৎসাহ থাকা প্রয়োজন। তরম্নণ গবেষক পলাশ বলেন, গবেষকদের কেউ কেউ বিদেশে চলে যেতে চান। তারা যাতে বিদেশে না গিয়ে দেশে অবস্থান করেন সেদিকেও সরকারের নজর থাকা প্রয়োজন। অতীতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার কারণে এমন অনেক গবেষক বিদেশে চলে গেছেন। গত বছর ডিসেম্বর মাসে যখন পাটের জেনম সিকোয়েন্স নিয়ে কাজ শুরু হয় তখন সবার মনে এটি ছিল একটি স্বপ্ন। আর এই কারণে সেদিন এই প্রকল্পের নাম রাখা হয়েছিল স্বপ্নযাত্রা। এই মহৎ যাত্রাকে এগিয়ে নিতে তারা সংবাদ মাধ্যমেরও ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। তরম্নণ গবেষক সরোজ রায় বলেন, এই গবেষণার সময় নিয়ে আমরা চিনত্মিত হইনি। প্রতিদিন ষোলো থেকে আঠারো ঘণ্টা আমরা কাজ করেছি। এ সব করা হয়েছে দেশের জন্য।
জেনম সিকোয়েন্সের ব্যাখ্যা দিয়ে গবেষকরা বলেন, এই প্রযুক্তির ফলে উদ্ভিদের কিছু জিনকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়, যার ফলে পাল্টে যায় গুণাবলী। উন্নত গুণাবলীর বীজ উদ্ভাবন, দ্রম্নত উৎপাদন ক্ষমতা, উন্নত সংরক্ষণ ক্ষমতা এবং অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ করা সম্ভব হয়। এই প্রযুক্তিতে বীজ ও চারার আগাছা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যায়। খরা, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে উৎপাদন ধরে রাখতে সহায়তা করে এই প্রযুক্তি। জেনম সিকোয়েন্সের বীজ দিয়ে লবণাক্ত মাটিতেও পাট উৎপাদন করা যাবে। উপকুলীয় এলাকাতেও হবে পাটের চাষ। জেনম সিকোয়েন্সের ফলে পাটকে কেন্দ্র করে ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার সম্ভাবনাও রয়েছে।
গবেষণা টিমের আরেক সদস্য সামিউল হক বলেন, উন্নতমানের পাটের আঁশ নির্ভর করে পানিতে পচানোর ওপর। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয় ও অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে দেশে পাট পচানোর মতো পর্যাপ্ত জলাশয় কমে আসছে। এই বিষয়টি মাথায় রেখে কম পানিতে বিশেষ পদ্ধতিতে যাতে পাট পচানো যায় সে ব্যাপারে গবেষণা করা হচ্ছে। গবেষক শহিদুল ইসলাম বলেন, পাটের জেনম সিকোয়েন্সির ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির মালিক থাকবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এককভাবেই এই প্রযুক্তির কৃতিত্ব অর্জন করতে যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। ভবিষ্যতে কোন দেশ কিংবা বিদেশী কোন প্রতিষ্ঠান পাট নিয়ে গবেষণা করতে হলে বাংলাদেশের অনুমতি নিতে হবে। হাওয়াই-এর জাতীয় আয়ের বড় উৎস হচ্ছে পেঁপে। সেদেশে পেঁপের জেনম সিকোয়েন্স করার পর তাদের উন্নত জাতের পেঁপে উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। একইভাবে মালশেয়িায় করা হয়েছে রবারের জেনম সিকোয়েন্স। আর এই দু'টি জেনম সিকোয়েন্স উদ্ভাবনের কৃতিত্বও পাটের জেনম সিকোয়েন্স করার গবেষক দলের প্রধান ডক্টর মাকসুদুল আলম। সেদিক থেকেও তিনি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন।
ডক্টর মাকসুদুল আলম এই গবেষণাকে চূড়ানত্ম রূপ দিতে সরকারের সাহায্য নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে আরও বলেন, আমি বামপন্থী নই, আবার ডানপন্থীও নই। আমি জানি সরকারও এই গবেষণার ব্যাপারে উদার। তাই আশা করি, সাহায্যের কোন সমস্যা হবে না। তবে সাহায্যগুলো আসতে হবে পূর্ণাঙ্গভাবে। আমার আছে দেশপ্রেম। দেশের স্বার্থেই আমি এই কাজটি চালিয়ে যেতে চাই। অনেক প্রতিযোগিতার মধ্যেও মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে আমরা পাটের জেনম সিকোয়েন্স করতে সক্ষম হয়েছি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা না দেয়া পর্যনত্ম কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল।
Source:Daily janakantha