Tuesday, January 11, 2011

জিন-নকশার উন্মোচনে বদলে যাবে পাট

জিন-নকশার উন্মোচনে বদলে যাবে পাট

২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের সোনালি আঁশের জিন-নকশা উন্মোচনের কথা বলে আসছে বিজ্ঞান প্রজন্ম। অবশেষে সেই পাটের জিন-নকশা উন্মোচিত হলো বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে বাংলাদেশেরই একঝাঁক নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানকর্মীর হাতে। এ নিয়ে বিশেষ আয়োজন

এ গল্পের শুরুটা নানাভাবে হতে পারে। এটির শুরু হতে পারে হাওয়াই দ্বীপের পেঁপের জিন-নকশা উন্মোচনে কিংবা মালয়েশিয়ায় রাবারের একই ঘটনায়। তবে আমরা যদি চাই, তাহলে এ গল্পের শুরু হতে পারে একজন পাদ্রির কৌতূহল নিয়ে। পাদ্রি গ্রেগর জোহান মেন্ডেল জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা করছিলেন। লম্বা আর খাটো মটরশুঁটির বৈশিষ্ট্য কীভাবে বংশ-বংশানুক্রমে প্রবাহিত হয়, সেটি জানতে গিয়ে তিনি সূচনা করেন এক নতুন বিজ্ঞানের। তাঁর হাত ধরে মানুষ জানতে পারে, দেখতে যেমনই হোক, বহিরাবরণে যা-ই থাক, জীবনের বৈশিষ্ট্যেরও একক আছে। তাঁর রকমফের থেকে জীবনের নানা প্রকাশ। পাদ্রি মেন্ডেলের এই বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড সেভাবে কারও নজরে আসেনি। শখানেক বছর পর নতুনভাবে আমরা তাঁর কথা জানলাম। আস্তে আস্তে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেতে শুরু করল বংশগতির বিজ্ঞান। আমরা জানলাম, জীবনের বৈশিষ্ট্যের একক হলো জিন, আর সেই বিজ্ঞান হলো জেনেটিকস।

তারপর আবার একটি লাফ। ৫০ বছর পর, আমাদের গল্পের নতুন এপিসোডের জোড়া নায়ক ওয়াটসন আর ক্রিক। দুজনের হাত ধরে আমরা জেনে গেলাম, জিনমাত্রই আসলে একধরনের এসিডের চাঞ্চল্য। নিউক্লিক এসিড (ডি-অক্সিরাইবো বা রাইবো)। পুরোটা বললে ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড ও আরএনএ (রাইবো নিউক্লিক এসিড)। ডিএনএর কাজ হলো, জীবনের জন্য কী ধরনের প্রোটিন বানাতে হবে, সেটির নির্দেশনা ধরে রাখা। আর আরএনএর কাজ হলো, সেই বার্তাটা বয়ে নিয়ে যাওয়া। তার মানে দাঁড়াল, জীবন শেষ বিচারে ডিএনএ বা আরএনএর দৌড়ঝাঁপ। একজন মানুষের চোখের রং নীল হবে না কালো হবে, তার তথ্যটি প্রথম মাতৃকোষেই লেখা থাকে! লেখা থাকে ডিএনএর দ্বিসূত্রকের বিন্যাসে। মাতৃকোষের বিভাজন থেকে শরীর গঠনের একপর্যায়ে চোখ গঠিত হয়। তখন আদি কোষের ডিএনএন থেকে আরএনএ নীল চোখের বার্তা পৌঁছে দেয় সেখানে। আমরা দেখি নীল নয়নাকে।

এভাবে আসলে সব জীবকোষের সব বৈশিষ্ট্য সঞ্চিত আছে জিনে। মোদ্দাকথা, কোনো জীবের জীবনকে বুঝতে চাও, তার জিনের অনুক্রম বা বিন্যাসটা জেনে নাও।

জিনবিজ্ঞানের মূল বিষয়টি আসলে এটাই। জীবনরহস্যের সমাধান জিন-নকশা।

এবার আমরা আমাদের গল্পে একটি বিরতি নিই। আমরা ফিরে আসি আমাদের জন্মভূমিতে, এই বাংলায়।

বাংলার কৃষকের হাত ধরে বিকশিত হয়েছে নানা জাতের ধান। এর কোনোটি লবণ সহ্য করতে পারে, কোনোটি বন্যার পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে, কোনোটি অল্প দিনে ফসল দিতে পারে। মেন্ডেল আর ক্রিকের বুদ্ধি দিয়ে আমরা বলতে পারি, এগুলোর আলাদা বৈশিষ্ট্যের কারণ যে জিন, সেগুলো প্রকাশিত। নানা ধরনের বৈশিষ্ট্যের ধান থেকে আমরা বাছাই করতে পারি আমাদের যেমনটি চাই, মোটামুটি সে ধরনের কিছু। সেগুলোকে আমরা নিয়ে যেতে পারি মাঠে। তাদের মধ্যে আমরা মুক্ত ব্রিডিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারি, ঠিক যেমনটি মেন্ডেল করেছিলেন, তবে আরও আধুনিকভাবে। ফল হিসেবে আমরা উচ্চফলনশীল ধান পেয়ে যাব। পেয়েছিও। ষাটের দশক থেকে শুরু হওয়া আমাদের ধানবিপ্লবে, ধান নিয়ে আমাদের ষাট-সত্তর-আশির দশকের বিপ্লবের মূলে ওই ব্রিডিংই।

ধানের কথা বললে আসে আমাদের সোনালি আঁশের কথা! পাট কেন সোনালি, স্বর্ণের রং বলে! পাঠক, আমাকে মারতে আসবেন। কারণ পাট তো দেখতে স্বর্ণালি নয়। তবুও কেন সে সোনার উপমা। কারণ আর কিছুই নয়, পাটের অর্থমূল্য। বাংলার মাটি পাট চাষের উপযোগী। পাটপণ্যের চাহিদা একসময় ছিল বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ফলাফল পাটের এ অঞ্চলের, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল হয়ে ওঠা। পাট হয়ে ওঠে আমাদের জন্য সোনার উপমা, স্বর্ণালি আশা।

সব আশার সঙ্গে নিরাশাও থাকে। উন্নত বিশ্বে হঠাৎ করে আবির্ভূত হয় প্লাস্টিক পণ্য, পলিথিন, কৃত্রিম তন্তু। রাতারাতি পরিবেশবান্ধব পাট হারিয়ে যায়। আমাদের পাটও হারিয়ে ফেলে তার স্বর্ণচ্ছটা। তবে দিনের আবার বদল হয়। মানুষ টের পেয়ে যায়, তার উৎপাদিত প্লাস্টিক পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে ফেলছে। শুরু হয় আবার পরিবেশবন্ধুর সন্ধান। উঁকি দেয় ফের পাটের স্বর্ণালি আশা।

তবে তত দিনে পদ্মার জল গড়িয়েছে অনেক। পুরোনো পাটে কিন্তু পারা যাবে না সবার সঙ্গে, বিশেষ করে প্লাস্টিকের সঙ্গে। চাই নতুন পাট। কেমন সেটা? যেমন আমাদের ধবধবে পাটের জাত। এটিতে লিগানিন কম। ফলে তন্তুটা ভালো, মিহি। কিন্তু ঝামেলা হলো, এটি বড়ই স্পর্শকাতর। পোকার আক্রমণ মোটেই সহ্য করতে পারে না।

অথবা পোকার আক্রমণ ঠেকাতে পারে এমন পাট। কিন্তু সেটিতে লিগানিন বেশি। পচানোর জন্য জাগ দিতে হয়, প্রচুর পানি লাগে। কাজেই লিগানিন কমওয়ালা পাট দরকার। কীভাবে পাওয়া যাবে? ধানের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ভাবলাম, প্রকৃতিতেও নিশ্চয়ই এমন পাট আছে। আমাদের কাজ হবে একটির বৈশিষ্ট্য আরেকটিতে ঢুকিয়ে দেওয়া। আর তা করতে গিয়েই আমরা পড়লাম বিপদে। কারণ, ধানের মতো হাজার জাতের পাট যে নেই! হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি জাতের পাট। কাজেই কেমন করে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আমরা পাব?

বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও ভাবেন। উন্নত জাতের পাটের উদ্ভাবন কেমন করে হবে। ঢাকার পাট গবেষণাগারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে কিংবা আলোচনায়, টেক্সাসের গবেষণাগারে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী—সবাই ভাবেন। আর শেষ পর্যন্ত তাঁরা ফিরে আসেন মেন্ডেল-ওয়াটসন আর ক্রিকের গল্পে। আমরা বুঝতে পারি, উন্নত জাতের পাট পেতে হলে আমাদের জানতে হবে পাটের মুক্ত বৈশিষ্ট্যের রহস্য, এর জিন-নকশা। পুরো জিন-নকশা জানার পর আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারব তার সদস্যদের চেনার কাজে। কোন জিন বাবাজি লিগানিনের প্রাবল্যের জন্য দায়ী, কোন জিনের অনুপস্থিতির জন্য বেচারা ধবধবে পাট হেরে যায় পোকার কাছে। যদি আমরা সেটা জানতে পারি, তাহলেই আমরা আমাদের স্বপ্নের পাট পেয়ে যাব। এটা শুধু যে বাংলাদেশ জানল তা নয়, জানল পাট উৎপাদনকারী সব দেশই। শুরু হলো এক নতুন, অদৃশ্য লড়াই। কে সবার আগে এই জিন-নকশা উন্মোচন করবে। এবার আমরা পাটের গল্প থেকে ‘একটি ছোট্ট বিরতি’ নিই।

জিন-নকশা উন্মোচনের কাজটি সহজ নয়। এর আগে মাত্র ১৬টি উদ্ভিদের সম্পূর্ণ জিন-নকশা উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয় হলো, এর মধ্যে দুটোই হয়েছে এক কীর্তিমান বাঙালির হাত ধরে। তাহলে তো কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল, তাই না। বাংলাদেশের পাটের জিন-নকশা উন্মোচিত হবে বাঙালি বিজ্ঞানীরই হাতে। ফরিদপুরের বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের হাতেই তবে হোক আমাদের সোনালি আঁশের সোনালি দিনের আহ্বান।

এ গল্পের পরের একটি এপিসোড এখন সারা বিশ্বের সবারই জানা। বাংলাদেশ সরকারের অর্থানুকূল্যে মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে পাটের জিন-নকশা উন্মোচিত হয়েছে।

জিন-নকশার এই উন্মোচন দুটি নতুন আলো দেখিয়েছে। প্রথম আলোর কথা আমি বলেছি শুরুতে। নতুন উন্নত জাতের পাট। কাজটি হবে ফাংশনাল জেনোমিকসের হাত ধরে। প্রথমে পাটের জিনগুলোর কোনটি কোন বৈশিষ্ট্যের, সেটি জানার মাধ্যমে। এর পর করতে হবে তার ব্যঞ্জনা। কোনটি থাকবে, কোনটি থাকবে না—কীভাবে কেটে, কীভাবে সাজালে আমরা পেয়ে যাব স্বপ্নের পাট। দীর্ঘ ও লম্বা সময়ের কাজ। হয়তো বছর পাঁচেক লেগে যেতে পারে।

দ্বিতীয় যে আলো দেখিয়েছে এই প্রকল্প, তা আমাদের নতুন প্রজন্মের আলো। আমাদের নতুন প্রজন্মকে এ কাজে যুক্ত করা তাদের গড়ে তোলা। সেটিও হয়েছে সার্থকভাবে। আমরা দেখেছি, যে কাজের জন্য অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন, সে কাজ আমাদের নতুন প্রজন্ম করেছে কাজ করতে করতে। এই নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে গড়ে উঠবে আমাদের বায়োটেকনোলজির নতুন ভুবন। তথ্যপ্রযুক্তি আর বায়োটেকনোলজির হাতে হাতে ধরে রচিত হবে আমাদের দিনবদলের নতুন কাব্য। এর কোনটিতে মূখ্য হবে পাট বা ধান, কোনটি জুড়ে থাকবে নতুন কোন প্রাণরক্ষাকারী ওষুধ।

আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।

সংগ্রহ: প্রথম-আলো
মুনির হাসান, তারিখ: ২০-০৬-২০১০

No comments:

Post a Comment